প্রশ্নোত্তর পর্ব ১ – ইসলামের দৃষ্টিতে বাসর রাতে করণীয়

ইসলামের দৃষ্টিতে বাসর রাত বা বিবাহের প্রথম রাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, এবং এই রাতে কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়—তা ইসলামিক আদব (শিষ্টাচার) ও সুন্নাহ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম ও করণীয় রয়েছে। বাংলারব্লগের প্রশ্নোত্তর প্রথম পর্বে – ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ের প্রথম রাতে করণীয় নিয়ে ১৬টি প্রশ্ন এবং উত্তর তুলে ধরা হলো।
ইসলামের দৃষ্টিতে বাসর রাতে করণীয়
বাসর রাতের স্বামী-স্ত্রীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর নিচে উল্লেখ করা হলো।
১। বাসর রাতে ঘরে প্রবেশের পর প্রথম কাজ কী হওয়া উচিত?
উত্তরঃ বাসর রাতে ঘরে প্রবেশের পর প্রথম কাজ হলো একে অপরকে সালাম দেওয়া এবং হাসিমুখে ও আন্তরিকভাবে কথা বলা।
২। বাসর রাতে নববধু কিভাবে সজ্জিত হবে?
উত্তরঃ নববধু তার সাধ্যের মধ্যে শরীয়তসম্মতভাবে সুন্দর পোশাক পরিধান করবে, মেহেদি ব্যবহার করবে এবং অলংকার দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করবে।
৩। বাসর রাতে নব দম্পতির জন্য কোনো বিশেষ নামাজ রয়েছে কি?
উত্তরঃ বাসর ঘরে প্রবেশের পর স্বামী নববধূকে সঙ্গে নিয়ে দুই রাকআত (শুকরানা) নামাজ আদায় করবে। (দেখুন- শিরআতুল ইসলাম, আহকামুল ইসলাম)
বিবাহের পর বাসর রাতের প্রথম সাক্ষাতে স্বামী তার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে জামাআতের সাথে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা উত্তম। এই নামাজ পড়া মুস্তাহাব। আবার অনেক আলেম এ দুই রাকআতকে নফল বলেছেন। নামাজের পর নবদম্পতি একে অপরের জন্য দোয়া করবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এই দোয়াটি তুলে ধরা হলোঃ

উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা বা-রিক লি ফি আহলি ওয়া বা-রিক লাহুম ফিইয়্যা, আল্লাহুম্মাঝ্মা’ বাইনানা মা জামা‘তা বিখাইরিন ওয়া ফাররিক্ব বাইনানা ইজা ফাররাক্বতা ইলা খাইরিন। (আদাবুয যিফাফ, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)
অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! আমার জন্য আমার পরিবারে বরকত দান কর এবং তাদের স্বার্থে আমার মাঝে বরকত দাও। হে আল্লাহ! তুমি যা ভাল একত্রিত করেছ তা আমাদের মাঝে একত্রিত কর। আর যখন কল্যাণের দিকে বিচ্ছেদ কর তখন আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ কর’।
৪। নামাজ পড়ার পর কি করবে?
উত্তরঃ অতঃপর স্বামী স্ত্রীর কপালের সামনের দিকের চুল ধরে “বিসমিল্লাহ” বলে নিচের দোয়াটি পাঠ করা সুন্নত।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا وَخَيْرَ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَمِنْ شَرِّ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা; ওয়া খাইরা মা জাবালতাহা আলাইহি; ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহা; ওয়া শাররি মা জাবালতাহা আলাইহি।’ (আবু দাউদ)
অর্থঃ ‘হে আল্লাহ! আমি এর যত কল্যাণ রয়েছে এবং যত কল্যাণ তার স্বভাবে আপনি দিয়েছেন তা চাই। আর এর যত অকল্যাণ রয়েছে এবং যত অকল্যাণ ওর স্বভাব-চরিত্রে আপনি রেখেছেন তা থেকেও আপনার আশ্রয় চাই।’
৫। বাসর ঘরে ঢুকে নামাজ ও দোয়া আদায় করার পর আর কোনো আমল আছে কি?
উত্তরঃ বাসর ঘরে ঢুকে উপরোক্ত আমলগুলো করতে বলা হয়েছে। এরপর পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হবে। উভয়ে মনের ভয়-ভীতি, সংকোচ এবং বিষন্নতা দূর করবে। আন্তরিকতা ও ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। দুধ বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া।
*তবে শুরুতেই স্বামীর উচিত মহর (মোহরানা) বিষয়ে আলোচনা করা।* স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত মোহরানা পরিশোধ করা স্বামীর ওপর ফরজ (আবশ্যকীয়) কর্তব্য।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের ফরজ মোহরানা পরিশোধ কর’ (নিসা ৪)। রসুলুল্লাহ বলেন, বিবাহের সবচেয়ে বড় শর্ত হল মোহর’। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত ৩১৪৩)
বাসর রাতে মোহরানা পরিশোধ করা সুন্নাত। ‘তবে বাধ্যগত অবস্থায় মোহর কিছু বাকী রেখে বিবাহ করা জায়েয’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত ৩২০২)। যদি সাথে সাথে মোহর আদায় করা সম্ভব না হয়, তাহলে স্ত্রী থেকে সময় চেয়ে নেওয়া উচিত এবং তা যথাসময়ে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া উত্তম।
৬। সহবাস শুরু করার পূর্বে সর্বপ্রথম কি করতে হবে?
উত্তরঃ সহবাস শুরু করার পূর্বে সর্বপ্রথম নিয়ত সহিহ করে নেয়া অর্থাৎ, এই নিয়ত করা যে, এই হালাল পন্থায় যৌন চাহিদা পূরণ করার দ্বারা হারামে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, তৃপ্তি লাভ হবে এবং তার দ্বারা কষ্ট সহিষ্ণু হওয়া যাবে, সওয়াব হাসিল হবে এবং সন্তান লাভ হবে। (দেখুনঃ আহকামে যিন্দেগী, আহকামুল ইসলাম)
৭। বাসর রাতে সহবাস করা কি ইসলামে নিষিদ্ধ?
উত্তরঃ না, এ সময় যে কোন উপভোগের জন্য স্বামী-স্ত্রী পূর্ণ স্বাধীন। তারা সন্তুষ্টচিত্তে যে কোন কাজ করতে পারে। তবে অবশ্যই প্রথম রাত হিসেবে একে অপরের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। (সূত্রঃ আহকামে যিন্দেগী, আহকামুল ইসলাম)
৮। পিরিয়ড/মাসিক চলাকালীন সহবাস করা যাবে কি?
উত্তরঃ না, মাসিকের সময় স্ত্রী সহবাস কুরআন-হাদীস উভয়ের আলোকেই নিষিদ্ধ। এই অবস্থায় বিয়ের পর বর ও কনের একসাথে দেখা সাক্ষাৎ ও একত্রে অবস্থান করা বৈধ, তবে কনে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা শরিয়তসম্মত নয়। (বিস্তারিত দেখুনঃ সুরা বাকারা: ২২২ , সহীহ মুসলিম; মিশকাত, হাদীস: ৫৪৫)
৯। সহবাসের শুরুতে কোন দোয়া পড়তে হবে?
উত্তরঃ সহবাসের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলে কাজ শুরু করা। পরে শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। উভয়কে একত্রে এভাবে বলা যায়-
بِسْمِ اللّهِ اللّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَ جَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا
উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়ত্বানা ওয়া জান্নিবিশ শায়ত্বানা মা রাযাক্বতানা।
অর্থঃ আমি আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করছি। হে আল্লাহ! তুমি শয়তানকে আমাদের নিকট থেকে দূরে রাখ এবং আমাদেরকে যে (সন্তান) দান করবে তার থেকেও শয়তানকে দুরে রাখ। (বুখারী ১৪১, মুসলিম ৩৬০৬নং)
১০। সহবাসের বিশেষ কিছু আদব ও বিধি-নিষেধ জানতে চাই?
উত্তরঃ সহবাসের কিছু আদব ও নিয়ম নিন্মরূপ-
- কোন শিশু বা পশুর সামনে সহবাস না করা।
- পর্দা ঘেরা স্থানে সহবাস করা।
- সহবাস শুরু করার পূর্বে শৃঙ্গার (চুম্বন, সংবেদনশীল স্থানে স্পর্শ করা, স্তন মর্দন ইত্যাদি) করবে।
- বীর্য মোছার জন্য এক টুকরা কাপড় রাখা।
- বীর্যের ও স্ত্রীর যৌনাঙ্গের প্রতি দৃষ্টি কম দেওয়া।
- সহবাসের পর পুনর্বার সহবাসে লিপ্ত হতে চাইলে যৌনাঙ্গ ধুয়ে ওযু করে নেওয়া।
- সংগম অবস্থায় বেশী কথা না বলা।
- সহবাসকালে বীর্যপাতের পর স্বামীর তৎক্ষণাৎ সরে না গিয়ে কিছুসময় অবস্থান করা উত্তম, যাতে স্ত্রীও পূর্ণরূপে নিজের চাহিদা পূরণ করতে পারে। এটি পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ।
- সহবাসের পর কিছুক্ষণ ঘুমানো উত্তম।
- জুমার দিন সঙ্গম করা মুস্তাহাব।
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার শারীরিক সম্পর্কের বিষয় অন্য কারো কাছে প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। এটি একদিকে নির্লজ্জতার পরিচয়, অপরদিকে স্বামী স্ত্রীর হক নষ্ট করা।
১১। সহবাস অবস্থায় স্ত্রীর যোনির দিকে নজর দেয়া যাবে কি না?
উত্তরঃ সহবাস অবস্থায় স্ত্রীর-যোনির দিকে নজর না দেওয়া। তবে হযরত ইবনে ওমর (রা.) সহবাস অবস্থায় স্ত্রী-যোনির দিকে দৃষ্টি দয়া উত্তেজনা বৃদ্ধির সহায়ক বিধায় এটাকে উত্তম বলতেন। (সূত্র – শরহুন নুকায়া ও হিদায়া)
১২। বীর্যপাতের সময় কোন দোয়া পড়বেন?
উত্তরঃ বীর্যপাতের সময় নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়বে-
اَللّٰهُمَّ لَا تَجْعَلْ لِلشَّيْطَانِ فِيْمَا رَزَقْتَنَا نَصِيْبًا
উচ্চারণঃ আল্লাাহুম্মা লাা তাজ‘আল লিশ শাইত্বাানি ফী মাা রযাক্বতানাা নাসীবাা।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যে সন্তান দান করবেন তাতে শয়তানের কোনো অংশ রাখবেন না। (ইবনে আবী শাইবা ৩ : ৪০২)
১৩। দাঁড়িয়ে সহবাস করা যাবে কি না?
উত্তরঃ হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে সহবাস করা যাবে। যারা বলে দাঁড়িয়ে সহবাস করা যাবে না তাদের কথা ঠিক নয়। (দেখুনঃ ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন, আল কাউসার, আহকামে যিন্দেগী)
১৪। স্বামী স্ত্রীর পরস্পর লজ্জাস্থানে মুখ দিতে পারবে কি?
উত্তরঃ সহবাস অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী একে অপরের লজ্জাস্থানে মুখ দেওয়া বা চোষা সম্পূর্ণ নিষেধ। এটি মাকরূহ এবং গুনাহের কাজ। এটা কুকুর, গরু, বকরী ইত্যাদি প্রাণীর স্বভাববের মত। তাই এই ধরণের কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
ভেবে দেখুন যেই মুখে পবিত্র কালিমা পড়া হয়, কোরআন তেলাওয়াত করা হয়, দরুদ শরীফ পড়া হয়, যেই মুখ দিয়ে খাওয়া হয় সেই মুখ দিয়ে এমন নিকৃষ্ট কাজ করা উচিৎ কি নাহ?। তাই এমন নিকৃষ্ট কাজ মুমিনের হতে পারে না। (দেখুনঃ ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া এবং আহকামে জিন্দেগী)
১৫। স্ত্রীর পিছনের রাস্তা দিয়ে বা পায়ুপথে সহবাস করা কি জায়েজ?
উত্তরঃ স্ত্রীর পায়ুপথে সহবাস কবিরা গুনাহ। কেননা, এটা হারাম হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট দলিল আছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন— ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে গুহ্যদ্বারে সঙ্গম করে সে অভিশপ্ত’। (আবূ দাঊদ, হা/২১৬২)
আরেক হাদিস, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন— ‘সেটি হচ্ছে ছোট সমকাম। অর্থাৎ পুরুষ নিজ স্ত্রীর মলদ্বার ব্যবহার করা’। (আহমাদ ৬৭০৬, ৬৯৬৭, ৬৯৬৮; বায়হাক্বী ১৩৯০০)
১৬। কোন কোন সময় স্ত্রী সহবাস নিসিদ্ধ?
উত্তরঃ নিম্নোক্ত অবস্থাগুলোতে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা শরিয়তসম্মত নয়।
১। স্ত্রীর মাসিক বা প্রসবকালীন স্রাব চলা কালে।
২। ইতিকাফ অবস্থায়।
৩। রমজান মাসে দিনের বেলায় রোজা অবস্থায়।
৪। হজ্জ বা উমরার ইহরাম অবস্থায়।
বাসর রাতে স্বামী স্ত্রীর করণীয় কাজ | শায়খ আহমাদুল্লাহ
বিয়ে করার আগে যে ৭টি প্রস্তুতি নিতে হবে – শায়খ আহমাদুল্লাহ
বাসর রাত স্বামী-স্ত্রীর নতুন জীবনের সূচনা। এই রাত শুধুমাত্র দাম্পত্য জীবনের শারীরিক শুরু নয়, বরং এটি পবিত্র সম্পর্কের সূচনাও। এই রাতটিকে সুন্দর, আন্তরিক ও ইসলামিক নীতি অনুযায়ী পরিচালনা করা উত্তম।
স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান, সহানুভূতি এবং ধৈর্য ধারণ করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা যেন সকল নবদম্পতির জীবন সুখ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করেন। আমিন।