প্রশ্নোত্তর পর্ব ২ – কোরবানি সম্পর্কিত সকল প্রশ্নের উত্তর

ইসলামে কোরবানি বা কুরবানী এক মহান ইবাদত। আমরা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ করে থাকি। আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য কোরবানি দিতে গিয়ে অনেকেই নানা প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান। যেমন —কোরবানি কী? কাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব? যেসব পশু কোরবানি করা যাবে? সর্বোচ্চ কতজন অংশগ্রহণ করতে পারবে? মাংস বণ্টন করার সঠিক নিয়ম কি? কোরবানির মাংস কতদিন পর্যন্ত রাখা যাবে? ইত্যাদি।
আর এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর জানা অত্যন্ত জরুরি, যাতে কুরবানী ইবাদত সঠিকভাবে পালন করা যায় এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হয়। বাংলারব্লগ প্রশ্নোত্তর পর্ব ২ নাম্বার পোস্টে আমরা কোরবানির সম্পর্কিত সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও সঠিক উত্তর তুলে ধরেছি।
কোরবানি সম্পর্কিত সকল প্রশ্নের উত্তর
ঈদুল আযহা বা কোরবানি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর জবাব নিচে দেওয়া হলো।
১। প্রশ্নঃ কোরবানি কী?
উত্তরঃ কোরবানি (আরবি: قربانى), কুরবান শব্দের অর্থ হলো নৈকট্য লাভ বা উৎসর্গ করা। ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা প্রতি বছর আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ফজর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত বা ঈদুল আযহার সময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবাই করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
এটি হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর আত্মত্যাগের স্মরণে পালন করা হয়ে থাকে, যিনি আল্লাহর নির্দেশে তার প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ) কে কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। পরে আল্লাহ তা’আলা তার পরিবর্তে একটি পশু পাঠিয়ে তাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেন।
২। কুরবানি সুন্নত নাকি ওয়াজিব?
উত্তরঃ ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদের মতে, সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি ওয়াজিব। অন্য মাজহাব অনুযায়ী এটি সুন্নতে মুয়ায়াক্কাদাহ।
৩। কাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব?
উত্তরঃ প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনও পুরুষ-নারী যদি ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। অর্থাৎ যার ওপর জাকাত ওয়াজিব হয়েছে, তার কোরবানিও ওয়াজিব।
৪। কোরবানি দেয়ার সঠিক সময় কখন?
উত্তরঃ কোরবানির সঠিক সময় হলো ঈদুল আযহার দিন অর্থাৎ ১০ জিলহজ ফজর থেকে এবং ঈদের পরবর্তী দুই দিন ১১ ও ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত, অর্থাৎ মোট তিন দিন।
৫। মহিলারা কি কোরবানি দিতে পারবে?
উত্তরঃ হ্যাঁ, অবশ্যই। যদি নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়, তাহলে মহিলারাও কুরবানি দিতে পারবে।
৬। মহিলারা কি কুরবানীর পশু জবাই করতে পারবে?
উত্তরঃ মহিলারা কুরবানীর পশু সহ সকল পশু জবাই করতে পারবে। কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, তার একটি ছাগল ‘সালআ’ নামক চারণক্ষেত্রে ছিল। তাঁর এক দাসী ছাগলটিকে মরণাপন্ন দেখে পাথর দ্বারা যবেহ করে দেয়। বিষয়টি তিনি রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি ছাগলটি খাওয়ার নির্দেশ দেন। (বুখারী, মিশকাত হাঃ ৪০৭২)
৭। মুসাফির ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা কী ওয়াজিব?
উত্তরঃ যদি কোন ব্যক্তি কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির হয় (অর্থাৎ বাড়ী থেকে ৪৮ মাইল (৭৭.২৩২ কিলোমিটার) অতিক্রম করে ১৫ দিনের মধ্যে ফিরে আসার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে) তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। (সূত্রঃ ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫)
৮। ঋণ থাকলে কুরবানি করতে হবে?
উত্তরঃ কেউ যদি সাময়িক ঋণগ্রস্ত থাকে, যা পরিশোধ করে দিলে তার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ বাকি না থাকে তাহলে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না। আর যদি ঋণ পরিশোধ করে দিলেও নেসাব পরিমাণ সম্পদ বাকি থাকে তাহলে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯২, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬)
৯। মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী দেওয়া জায়েজ কিনা?
উত্তরঃ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে বা নামে কুরবানি করা জায়েজ আছে। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানি হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর গোশত স্বাভাবিক নিয়মে বন্টন করতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না।
১০। যেসব পশু দ্বারা কোরবানি করা বৈধ?
উত্তরঃ কোরবানির জন্য গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট, ও দুম্বা জায়েজ করা হয়েছে। রাসুল (সাঃ) এই ৬টি পশু ব্যতীত অন্য কোনো পশু কুরবানি করেননি এবং অনুমোদন দেয়নি। ছাগল-ভেড়ার জন্য ১ বছর, গরু ও মহিষের জন্য ২ বছর এবং উটের জন্য ৫ বছর বয়স হওয়া আবশ্যক।
শর্ত* অসুস্থ, অন্ধ, পঙ্গু এবং আহত পশু কোরবানি করা জায়েজ নেই।
১১। কুরবানীর পশুর বয়স কত হতে হবে?
উত্তরঃ কোরবানির জন্য উটের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স ২ বছর এবং ছাগল ও ভেড়ার বয়স ১ বছর হতে হবে।
১২। পাঁঠা কোরবানি করা যাবে কি?
উত্তরঃ পাঁঠা ছাগলের অন্তর্ভুক্ত তাই পাঁঠা কোরবানি করা যাবে। বাংলাদেশে অনেকেই মনে করেন পাঁঠার মাংস খাওয়া জায়েজ হবে কিনা? পাঁঠার মাংস খাওয়া জায়েজ এবং তা কুরবানিও করা যাবে। তবে খাসি ছাগল কুরবানি দেওয়া উত্তম। কারণ রাসুল (সাঃ) খাসি কুরবানী দিয়েছিলেন।
১৩। একটি পশুতে সর্বোচ্চ কতজন অংশগ্রহণ করতে পারবে?
উত্তরঃ ছাগল, ভেড়া, এবং দুম্বা এই ছোট পশুগুলো কেবল একজনই কোরবানি দিতে পারবে। এসব পশু একাধিক ব্যক্তি মিলে কুরবানী করা জায়েজ নেই। আর উট, গরু, এবং মহিষ এই বড় পশুগুলোতে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরীক হতে পারবে।
হযরত জাবের রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে হজ করেছিলাম, তখন আমরা সাতজন করে একটি উট এবং একটি গরুতে শরিক হয়ে কোরবানি করেছি।’ (মুসলিমঃ ১৩১৮)
১৪। কুরবানীর পশু জবাই করার সঠিক সময় কখন?
উত্তরঃ পশু জবাইয়ের সঠিক সময় জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদের নামাজের পর থেকে শুরু করে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত। নামাজের আগেই কেউ যদি কুরবানীর পশু জবাই করে তার কোরবানি হবে না।
১৫। কোরবানির পশু জবাই করার আগে কি করতে হবে?
উত্তরঃ একটি পশুতে একাধিক অংশীদার হলে, কোরবানির পশুর দাম এবং খরচ হিসাব করে সমান ভাগে ভাগ করে দেনা পাওনা পরিশোধ করা উত্তম।
১৬। কিভাবে কোরবানির পশু জবাই করতে হবে?
উত্তরঃ কোরবানির পশু জবাই করার আগে ছুরি ভালো করে ধার দিয়ে নিতে হবে যাতে পশুর বেশি কষ্ট না হয়। তারপর পশু কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে। পশুটিকে এমনভাবে ধরতে হবে বা বেঁধে নিতে হবে যেন জবাইয়ের ছুটতে না পারে। পশুর গলায় ছুরি চালানোর সময় “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলতে হবে। শুধু “বিসমিল্লাহ” বললেও হবে। এছাড়াও আর কিছু দোয়া রয়েছে।
ছুরি চালানোর সময় পশুর গলার মূল ৩টি অঙ্গ কেটে দিতে হয়। এর মধ্যে ১। খাদ্যনালি, ২। শ্বাসনালি, ৩। শ্বাসনালির দুই পাশে দুটি মোটা রগ রয়েছে সেই দুটি। যদি ঠিকমতো এই অঙ্গগুলো কাটা হয় তাহলে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে পড়বে।
আবার অনেকেই আছে গরু জবাই করতে গিয়ে ছুরি চালানোর পর ছুরির মাথা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে বা ঘা দেয়, মেরুদণ্ডের সঙ্গে ঘাড় পর্যন্ত যে স্পাইনাল কর্ড রয়েছে, সেটির রগ কাটার জন্য চেষ্টা করে। এ ধরনের খোঁচাখুঁচি কোনোভাবেই করা যাবে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, এভাবে খোঁচাখুঁচির করলে পশুটি মৃত্যুর আগেই একবার হার্টফেল করে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত।
পশু জবাই করার পর পশু নিস্তেজ হতে সময় দিন। অনেকে আছে পশু নড়াচড়া করা অবস্থায় পায়ের রগ কাটা বা চামড়া ছিলানো শুরু করে দেয়। এটা ঠিক না, এভাবে জবাই করাকে জবাই করা বলে না বরং হত্যা করা বলে।
১৭। কিভাবে কোরবানির মাংস বন্টন করতে হবে?
উত্তরঃ কোরবানির মাংস বানানো শেষ হলে সব মাংস মেপে তিনভাগে ভাগ করতে হবে। একভাগ নিজেদের, একভাগ প্রতিবেশীদের দিতে হবে এবং একভাগ গরিব-মিসকিনদের জন্য।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরবানির মাংস তিনভাগে বণ্টন করতেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) কোরবানির গোশত একভাগ নিজের পরিবারকে খাওয়াতেন, একভাগ গরীব প্রতিবেশীদের দিতেন এবং একভাগ গরিব-মিসকিনদের দিতেন।
১৮। অমুসলিমদেরকে কুরবানীর মাংস দেওয়া যাবে কি?
উত্তরঃ হ্যাঁ, কুরবানীর মাংস অমুসলিমদের দেওয়া যাবে। যদি অমুসলিমরা প্রতিবেশী হয় এতে বাধা নেই। কারণ প্রতিবেশী হিসেবে তাদের হক রয়েছে।
১৯। কোরবানির পশু জবাই করা পর্যন্ত না খেয়ে থাকার বিধান কী?
উত্তরঃ ঈদের দিন কোরবানির পশু জবাই করা পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হবে কথাটি সঠিক নয়।
২০। কোরবানির মাংস কতদিন পর্যন্ত রাখা/খাওয়া যাবে?
উত্তরঃ আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত জমিয়ে বা ফ্রিজে রাখা যাবে না। তবে এটি ভুল ধারণা। কোরবানির মাংস যত দিন ইচ্ছা খাওয়া যাবে বা ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যাবে এতে কোনো বাধা নেই। (সূত্রঃ সহীহ মুসলিম; [ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নাম্বারঃ ৪৯৪২] [হাদিস একাডেমি, হাদিস নাম্বারঃ ৪৯৯৭)
২১। কোরবানির পশুর চামড়ার বিধান কি?
উত্তরঃ কুরবানীদাতা চাইলে কুরবানী করা পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে নিজেই ব্যবহার করতে পারবে। বিক্রি করা যাবে না। আর যদি বিক্রি হয় তাহলে সেই টাকা নিজেরা খরচ করতে পারবেন না। এই টাকা গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে।
২২। কোরবানির সাথে আকিকা দেয়া যাবে কি?
উত্তরঃ আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন কোরবানির সাথে আকিকা দেওয়া জায়েজ নাই। কিন্তু না, কোরবানির পশু দিয়ে আকিকা করতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে ছাগল, ভেড়া, এবং দুম্বা এই পশুগুলো একাধিক অংশীদার হয়ে কুরবানী দেওয়া জায়েজ নেই, তাই এই পশুগুলো দিয়ে এক সাথে কোরবানি এবং আকিকা হবে না।
যেহেতু গরু, মহিষ এবং উটে সর্বোচ্চ সাতটি অংশে কোরবানি দেওয়া যায়, তাই এই পশুগুলোতে এক বা একাধিক অংশ দিয়ে আকিকা করা জায়েজ আছে।
শেষকথা
কোরবানি শুধু পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি একজন মুসলমানের ঈমান, তাকওয়া ও আত্মত্যাগের বাস্তব পরীক্ষা। সুতরাং, কুরবানীকে শুধুমাত্র সামাজিক রীতি হিসেবে না দেখে তা যেন হয় ইখলাসের সাথে আদায়কৃত ইবাদত।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক ভাবে কোরবানির ইবাদত পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সবাই কে ঈদুল আযহার অগ্রিম শুভেচ্ছা ও দোয়া রইল।